প্রকাশের তারিখ : ১৯ নভেম্বর ২০২৫
গাজার ইতিহাস চুরি: ইসরায়েলের হাতে কাসর আল-পাশা ধ্বংস, ২০ হাজার প্রত্নবস্তু লুট!
গাজায় দুই বছর ধরে চলা হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসাত্মক অভিযানের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মুছে ফেলার এক নজিরবিহীন ও সুপরিকল্পিত অভিযানে নেমেছে ইসরায়েল। সর্বশেষ শিকার হয়েছে গাজার অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন, আট শতক পুরনো 'কাসর আল-পাশা' বা 'পাশার প্রাসাদ'। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, ধ্বংসের আগে এখান থেকে প্রায় ২০ হাজার দুষ্প্রাপ্য প্রত্নবস্তু লুট করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ৩১৬টিরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও ভবন আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে মানব ঐতিহ্যের ওপর গুরুতর আক্রমণ।গাজার আল-দারাজ এলাকার পুরাতন শহরে অবস্থিত 'কাসর আল-পাশা' মামলুক (১২৫০-১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ) স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন, যার আনুমানিক বয়স প্রায় আট শতাব্দী। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে এটি গাজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল।ব্যাপক ধ্বংস ও সাংস্কৃতিক চুরিসাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশেষজ্ঞ হামুদা আল-দেহদার (পশ্চিম তীরের বেথলেহেমের হেরিটেজ কনজারভেশন সেন্টারের) মতে, ইসরায়েলি আক্রমণে প্রাসাদটির ৭০ শতাংশেরও বেশি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর ভেতর থেকে মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী চুরি হয়েছে। তিনি জানান, প্রাসাদটিতে বাইজেন্টাইন, রোমান এবং উসমানীয় আমলের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু ছিল। ইসরায়েল ১৯৯৪ সালে গাজা থেকে চলে যাওয়ার পর প্যালেস্টাইন অথরিটি এটিকে পুনরুদ্ধার করে জাদুঘরে পরিণত করেছিল।গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের পরিচালক ইসমাইল আল-থাওয়াবতেহ আনাদোলু এজেন্সিকে নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনি পরিচয় মুছে ফেলার নীতি নিয়ে সুসংগঠিতভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তার তথ্যমতে, এই বাহিনী ৩১৬টিরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও ভবন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করেছে, যার বেশিরভাগই মামলুক ও উসমানীয় যুগের।২০ হাজার প্রত্নবস্তুর রহস্যজনক অন্তর্ধানআল-থাওয়াবতেহ বলেন, "গাজার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো শুধু ধ্বংসের শিকার হয়নি, বরং তা সংগঠিত লুটের শিকার হয়েছে। এই কাজ আন্তর্জাতিক আইনে শাস্তিযোগ্য এবং মানব ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি আক্রমণ।" তিনি জানান, ইসরায়েলি অভিযানের সময় হাজার হাজার প্রত্নবস্তু 'কাসর আল-পাশা' থেকে গায়েব হয়ে যায়। এই জাদুঘরে প্রাক-খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে উসমানীয় আমল পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার দুষ্প্রাপ্য প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত ছিল। ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহারের পর একটিও প্রত্নবস্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি, যা প্রমাণ করে সেগুলো চুরি ও পাচার করা হয়েছে।তিনি এটিকে "গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অপরাধ" হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যা কেবল জাতীয় পরিচিতি নয়, সমগ্র মানবজাতির ঐতিহ্যকে আঘাত করে।ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্থাপত্যশৈলীপর্যটন ও প্রত্নতত্ত্ব মন্ত্রণালয়ের (গাজা) ২০২২ সালের একটি নির্দেশিকা অনুযায়ী, 'কাসর আল-পাশা' ফিলিস্তিনের ইসলামি স্থাপত্যের বিবর্তনকে তুলে ধরে। এর মূল প্রবেশদ্বারে মামলুক সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত 'ডাবল লায়ন' (দুটি সিংহ) খোদাই করা আছে, যা মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের প্রতীক। প্রাসাদটি দুটি পৃথক ভবন এবং একটি বড় বাগান নিয়ে গঠিত। এর দক্ষিণাংশের প্রবেশদ্বারে তারকামণ্ডিত জ্যামিতিক নকশা, তীক্ষ্ণ ও অর্ধ-গোলাকার খিলান এবং ঘোড়ার খুরের মতো খিলান (Horseshoe Arch) দেখা যায়, যা ইসলামি স্থাপত্যের সমৃদ্ধি নির্দেশ করে।ঐতিহাসিকভাবে প্রাসাদটি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল: মামলুক যুগে এটি 'দার আল-সা'আদা' (Dar Al-Sa'adah), উসমানীয় যুগে 'কাসর আলে রিদওয়ান' এবং ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়নের আক্রমণের সময় 'নেপোলিয়ন ক্যাসেল' নামে পরিচিতি লাভ করে।ধ্বংসের পরে, ফিলিস্তিনি প্রত্নতত্ত্ব দলগুলো বর্তমানে স্থানীয় সংস্থা এবং বেথলেহেমের হেরিটেজ কনজারভেশন সেন্টারের সাথে সমন্বয় করে অবশিষ্ট প্রত্নবস্তু উদ্ধারের এবং ভবিষ্যতে পুনরুদ্ধারের জন্য প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের জরুরি কাজ করছে।
কপিরাইট © ২০২৫ কওমী টাইমস । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত