ঢাকা    রোববার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
ঢাকা    রোববার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
কওমী টাইমস

ইসরায়েলি বসতি স্থাপন: অবৈধ কার্যক্রমের অর্থের উৎস কারা?

দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে, বিশেষত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ এবং বসতি স্থাপনকারীদের স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠার মূল চালিকাশক্তি হলো অর্থায়ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বারবার আহ্বান সত্ত্বেও ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে বসতি স্থাপন কার্যক্রম জোরদার করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ। বসতি স্থাপনকারী সংস্থাগুলো সাধারণত তাদের বাজেট ও বিদেশী উৎসের কথা গোপন রাখলেও, অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী এই কার্যক্রমের বেশিরভাগ অর্থ আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইহুদি দাতব্য সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যায়ে দেওয়া বিশাল অনুদান থেকে।বসতি স্থাপন কার্যক্রমকে টিকিয়ে রাখা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিদেশী অর্থায়ন প্রধানতম ভূমিকা পালন করে। এই অর্থ কেবল নির্মাণ কাজেই নয়, বরং চরমপন্থী ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষা এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে দোষী সাব্যস্ত বসতি স্থাপনকারী পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্যও ব্যবহৃত হয়।বিদেশী অর্থায়নের উৎস ও পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি সংস্থা: ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ‘হারেৎজ’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৫০টিরও বেশি আমেরিকান ইহুদি সংস্থা পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপনকারীদের কাছে প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন শেকেল) পাঠিয়েছে। এসব তহবিল কর-মুক্ত সুবিধা ভোগ করে, যা প্রকারান্তরে বসতি নির্মাণ ও ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।প্রধান তহবিলদাতা: বসতি স্থাপন কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান তহবিলদাতাদের মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক "সেন্ট্রাল ফান্ড অফ ইসরায়েল" এবং ব্রুকলিনভিত্তিক "হিব্রন ফান্ড"। 'হিব্রন ফান্ড' ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শুধু হেব্রন শহরের বসতি স্থাপনের জন্য ৪.৫ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থায়ন করেছে।বড় আকারের দান: 'ইয়ালগাড' নামক একটি সংস্থা ২০০৬ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এই অর্থের অর্ধেকেরও বেশি বাহামা, ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এবং সেশেলসের মতো বিদেশী স্থান থেকে এসেছে, যার দাতাদের পরিচয় স্পষ্ট নয়। রাশিয়ান-ব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার রোমান আব্রামোভিচও বসতি স্থাপনকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন।উদ্দেশ্যের বৈচিত্র্য: অর্থায়ন শুধু বসতি নির্মাণে সীমাবদ্ধ নয়। হারেৎজ জানিয়েছে, এই তহবিল উগ্রপন্থী ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত বসতি স্থাপনকারীদের পরিবারকে সহায়তা করার কাজেও ব্যবহৃত হয়।আন্তর্জাতিক ও বহুজাতিক কর্পোরেট সংযোগজাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার (OHCHR) ২০২৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি বসতিতে কর্মরত কোম্পানিগুলোর একটি হালনাগাদ ডেটাবেস প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় ১৫৮টি কোম্পানি যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ১৩৮টি ইসরায়েলি এবং বাকি ২০টি ১০টি ভিন্ন দেশের। মার্কিন কোম্পানি: এই তালিকায় ৬টি বৃহৎ মার্কিন কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে Airbnb, Booking Holdings, Expedia Group, Motorola Solutions, Re/Max Holdings এবং TripAdvisor।ইউরোপীয় কোম্পানি: স্পেন থেকে ৪টি, ফ্রান্স (২টি), যুক্তরাজ্য (২টি) সহ কানাডা, চীন, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি এবং পর্তুগালের একটি করে কোম্পানি এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। বেশিরভাগ বিদেশী কোম্পানি নির্মাণ, রিয়েল এস্টেট, পর্যটন এবং যোগাযোগ খাতে সক্রিয়।ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ইসরায়েলি ব্যাংক: হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরায়েলের ৭টি বৃহত্তম ব্যাংক— যার মধ্যে Hapoalim, Leumi, Discount ও Mizrahi-Tefahot অন্তর্ভুক্ত— বসতি স্থাপন কার্যক্রমে সরাসরি পরিষেবা দিয়ে সহায়তা করছে।ফরাসি ব্যাংক: ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (FIDH) ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে জানায়, চারটি ফরাসি ব্যাংক (BNP Paribas, Société Générale, Crédit Agricole, BPCE) এবং একটি বীমা কোম্পানি (AXA) পরোক্ষভাবে ইসরায়েলি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বসতি স্থাপন কার্যক্রমে অবদান রাখছে।পশ্চিম তীরে সহিংসতা ও সম্প্রসারণ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় গণহত্যার পাশাপাশি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং বসতি স্থাপনকারীরা পশ্চিম তীরে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বহুগুণ বাড়িয়েছে, যার প্রধান লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে বসতি সম্প্রসারণ করা। হতাহত ও গ্রেফতার: গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরে অন্তত ১০৭৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত, প্রায় ১০,৭০০ জন আহত এবং ২০,৫০০ জনেরও বেশি গ্রেফতার হয়েছেন।বসতি স্থাপনকারী হামলা: ফিলিস্তিনের সরকারি সংস্থা 'ওয়াল অ্যান্ড সেটেলমেন্ট রেজিস্ট্যান্স কমিশন' এর তথ্যমতে, গত দুই বছরে বসতি স্থাপনকারীরা ৭,১৫৪টি হামলা চালিয়েছে, যাতে ৩৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ৩৩টি জনবসতি উচ্ছেদ হয়েছে। বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা: মানবাধিকার সংস্থা 'বিতসেলেম'-এর তথ্যমতে, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা বর্তমানে ৭,৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৮% বেশি।

ইসরায়েলি বসতি স্থাপন: অবৈধ কার্যক্রমের অর্থের উৎস কারা?